ভূমিকা: যুগে যুগে আল্লাহর মকবুল বান্দাগণ পথহারা মানব জাতিকে সত্যের পথ্যের সন্ধান দেওয়ার জন্য আবির্ভূত হন। মানুষকে শরীয়ত ও তরীক্বত সম্মত পথনির্দেশনা যে সব ক্ষণজন্মা মনীষী দিয়ে গেছেন হযরত আলহাজ্ব শাহ্ আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ ছিদ্দীকী হামেদী (রহঃ) তাঁদেরই একজন। চৌদ্দশত হিজরীর মুজাদ্দেদ হযরত শাহ্ সৈয়দ আবদুল বারী (রহঃ) এর পদাঙ্ক অনুসরণ এবং অলিকুল শিরোমণি হযরত শাহ্ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী আজমগড়ী (রহঃ) এর স্নেহধন্য হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) তাঁরই অগ্রজ হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর হুবহু ছায়া হিসেবে শরীয়ত ও তরীক্বতের মহান জিম্মাদারীর আঞ্জাম দেন। তিনি ছিলেন মুজাদ্দেদে যমান এবং অত্যন্ত উঁচু মাপের আল্লাহর মকবুল বান্দা। তাঁর বিশাল ও বর্ণাঢ্য জীবন এবং সুপরিসর অবদান এর কিয়দাংশ মাত্র বক্ষমান প্রবন্ধে উল্লেখ করা হল।
জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
মোজাদ্দেদে যমান অলিয়ে কামেল হযরত আলহাজ্ব শাহ্ আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ ছিদ্দীকী হামেদী (রহঃ) (প্রকাশ ছোট হুজুর কেবলা রহঃ) চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলা সদরের প্রায় ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে গারাংগিয়া নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। সম্ভ্রান্ত ও প্রখ্যাত ছুফি পরিবারে হযরত ছুফি আলাউদ্দিন মিয়াঁজির ঔরসে জানা মতে ১৯০০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ পবিত্র আরবভূমি থেকে চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়াস্থ দেয়াং পাহাড়ে এসে বসতি স্থাপন করেন। তথা হতে তাঁর পিতা হযরত ছুফি মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মিয়াঁজি সাতকানিয়া উপজেলার গারাংগিয়াস্থ হাতিয়ার খাল সংলগ্ন ভরিয়ার কুল নামক স্থানে কিছুকালের জন্য বসতি স্থাপন করেন। অতঃপর আরো উত্তম বিবেচনা করে একই গ্রামের বর্তমান ডলুখাল সংলগ্ন পশ্চিম পাড়ে এসে উর্বর প্রাকৃতিক পরিবেশে স্থায়ীভাবে বসতি গড়া শুরু করেন। তাঁর দাদার নাম হযরত ছুফি আমিনুদ্দীন মিয়াঁজী এবং নানার নাম খাজা মোহাম্মদ আলী মিয়াঁজী। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) পিতার দিক দিয়ে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) এর বংশধর বলে জানা যায় এবং মাতার দিক দিয়ে ইসলামের ৪র্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর বংশধর বলে জানা যায়।হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর মাতার নাম মোছাম্মৎ রাহাত জাহান বেগম মতান্তরে রাহাতুন্নেছা বেগম। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর পিতামাতা উভয়ে অত্যন্ত ধর্ম পরায়ণ, নেক্কার তথা আল্লাহর ওলী ছিলেন। হযরত ছুফি আলাউদ্দিন মিয়াঁজি তাঁরবাড়ীতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে পবিত্র কোরআন মজিদসহ ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন। তিনি হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর অতি আগ্রহে হযরত আজমগড়ী (রহঃ)’র হাতে তরীক্বতে দাখিল হয়েছিলেন ১৯২৮ সালে। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর পিতা একজন উঁচু মাপের আল্লাহর ওলী ছিলেন। তখনকার আমলে তাঁর ত্বাকওয়া-পরহেজগারী চাল-চলনে স্বীকৃত ছিল বলে জানা যায়। তাঁর বহু কারামত তখনকার আমলে এলাকার লোকজনের মুখে মুখে ছিল। তিনি ১৯৩৩ সাল মোতাবেক ১৩৫২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ শুনে চিঠির মাধ্যমে সুদূর আজমগড় থেকে হযরত আজমগড়ী (রহঃ) সমবেদনা প্রকাশ করেন। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর মাতা মোছাম্মৎ রাহাতজাহান বেগম খুবই পর্দানশীল এবং ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের দরগাহ্ মুড়া নামক এলাকার এক সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারের কন্যা ছিলেন। তাঁর বুজুর্গ স্বামী অকালে ইন্তিকাল করার পরও বড়পুত্র হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) কে সামনে রেখে স্বামীর সংসার তথা পুত্রকণ্যাগণকে মানুষ করতে দৃঢ় মনোবলের সাথে সংসারের হাল ধরেছিলেন। তিনি ১৯৩৮ সাল মোতাবেক ১৩৫৭ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। উভয়ে গারাংগিয়া আলীয়া মাদরাসা কম্পাউন্ডে জামে মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব সংলগ্ন কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। হযরত আজমগড়ী (রহঃ) এর অন্যতম খলিফা হযরত শাহ্ মাওলানা আব্দুস ছালাম আরকানী (রহঃ) বারে বারে গারাংগিয়া সফর করতেন। তিনি হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর পিতা-মাতার কবর শরীফ জেয়ারতকালীন কবরদ্বয়ের রৌশনির ব্যাপারে মন্তব্য করেন।
পারিবারিক পরিচিতিঃ
হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) ৩ ভাই ৫ বোনের মধ্যে পঞ্চম। তাঁরা দু’মায়ের সন্তান। বড় মায়ের ঘরে একমাত্র কন্যা মোছাম্মৎ মফিজা খাতুন। তাঁকে হুজুরের নানার বাড়ী দরগাহ্ মুড়া এলাকায় শাদী দেয়া হয়। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) নিজ মায়ের ৩ ভাই ৪ বোন। এদের মধ্যে সকলের বড় হচ্ছেন কুতবুল আলম, সুলতানুল আউলিয়া হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ (রহঃ) (হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)। অতঃপর মোছাম্মৎ মফজল খাতুন যাঁকে হুজুরের নানার বাড়ী দরগাহ্ মুড়া গ্রামে শাদী দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ঐ পরিবার হুজুরের পৈত্রিক বাড়ীর উত্তর পার্শ্বে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন অতঃপর হযরত হাফেজ আব্দুল লতীফ (রহঃ) (প্রকাশ হযরত মেঝ হুজুর কেবলা (রহঃ) তারপর হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর অনুজ পরপর তিন বোন প্রথম হলেন মোছাম্মৎ নাছিমা খাতুন। তাঁকে লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়ায় শাদী দেওয়া হয়। অতপর বেলায়াতজান। তাঁকে লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া কুমিরাঘোনা এলাকায় শাদী দেওয়া হয়। অতঃপর ইলম খাতুন যাঁকে সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া এলাকায় শাদী হয়। যতটুকু জানতে পারি হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) সম্ভবত ৩০ বছর বয়সে দাম্পত্য জীবনে পা রাখেন। ১৯৬৫ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রী ইন্তেকাল করলে পরে বছর খানেক পর ২য় শাদী করেন। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর প্রথম সংসারে ৫ পুত্র ও ১ কন্যা এবং ২য় সংসারে ১ পুত্র ও ১ কন্যা রেখে যান।
শিক্ষা জীবনঃ
হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) নিজ বাড়িতে তাঁর পিতার নিকট প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর কিছুদিন গারাংগিয়া গ্রামের পূর্ব সংলগ্ন বারোদোনা গ্রামের এক মাদরাসায় লেখাপড়া করেছিলেন। ১৯২০ সালে গারাংগিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করলে হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)এর আগ্রহে গারাংগিয়া মাদরাসা চলে আসেন লেখাপড়ার নিমিত্তে। অতঃপর আরো উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী দারুল উলূম আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)’র আগ্রহে চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁওস্থ হযরত বড় হুজুর কেবলা যে বাড়ীতে ছিলেন ঐ বাড়িতে জাগীর থাকেন। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) কৃতিত্বের সাথে দারুল উলূম মাদরাসায় লেখাপড়া শেষ করেন।
কর্ম জীবনঃ
১৯২৬ সালে হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর অতি আগ্রহে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) গারাংগিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন হেড মাওলানা তথা আউয়াল সাহেব পদে। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময় তিনি তাঁরই অভিভাবক মুরুব্বী হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর নিয়ন্ত্রন এবং তার দক্ষিণ হস্ত তথা সহযোগী হিসেবে গারাংগিয়া মাদরাসায় খেদমত করে যান। হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) ১৯৬৯ সালে গারাংগিয়া মাদরাসা দায়িত্ব থেকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে অবসরে গেলেহযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)এর ইচ্ছায় গারাংয়গিয়া মাদরাসার সুপারিনটেনডেন্ট/অধ্যক্ষপদ অলংকৃত করেন। ১৯৭১ সালে সরকারি ভাবে অধ্যক্ষের পদ হতে অবসর নিয়ে গভর্নিং বডির সভাপতির পদ অলংকৃত করেছিলেন এবং ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে বহাল ছিলেন। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে সর্বমহলে হযরত আউয়াল সাহেব হুজুর লক্ববে খ্যাতি লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, গারাংগিয়া মাদরাসায় সে সময়ে কোন উস্তাদকে নাম ধরে ডাকা হতো না। যা বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) ও ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর শিক্ষা তাই সর্বসম্মতভাবে বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) কে সুপারিনটেনডেন্ট ছাহেব হুজুর এবং হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) কে আউয়াল ছাহেব হুজুর লক্ববে ডাকা হতো। ১৯৬৯ সাল থেকে আজ অবধি তিনি হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) লক্ববে সর্বমহলে খ্যাতিমান।
তরীক্বতে পদার্পণঃ
হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর অতি আগ্রহে ১৯২৮ সালে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) হযরত আজমগীড় (রহঃ) এর হাতে তরীক্বতের দাখিল হন এবং কিছুদিনের মাথায় বায়আত গ্রহণ করেন। তিনি গারাংগিয়া মাদরাসার খেদমতের পাশাপাশি একান্ত মনে তরীক্বত্বের কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। তিনি যে শরীয়তের পাশাপাশী তরীক্বত তথা আধ্যাত্মিক জগতের উচ্চাঙ্গে পৌঁছে যান তা হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) ও হযরত আজমগীড় (রহঃ) এর অজানা ছিল না। বিশেষ করে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) ও চট্টগ্রাম জেলার দোহাজারীস্থ হযরত মাওলানা আবদুল হাকীম (রহঃ) তরীক্বতের দিক দিয়েও হযরত বড় জুর কেবলা (রহঃ) এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকতেন। হযরত আজমগীড় (রহঃ) এর সাথে পত্রালাপের মাধ্যমে হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ)ও হযরত মাওলানা আবদুল হাকীম (রহঃ) কে বিশেষ তরীক্বতের সফরে আজমগড় পাঠিয়েছিলেন। তখন এবং আজও আজমগড় যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে একমাত্র রেল-ই বাহন ছিল। সেকালে চট্টগ্রাম থেকে আর একালে কলকাতা থেকে স্বাভাবিক নিয়ম ছিল বান্ডেলে হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর হাওড়া রেল স্টেশনে বিশেষ কারামত হিসেবে উভয় হুজুরকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এমনিতে গারাংগিয়া মাদরাসার খেদমতের সময় সুযোগ বুঝে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) সময়ে সময়ে আজমগড় যেতেন। অপরদিকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত হযরত আজমগীড় (রহঃ) বাৎসরিক একবার ত্বরিক্বতের তাবলীগের সফরে চট্টগ্রাম আসলে পরে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) তাঁর মোলাকাত পেতে সচেষ্ট থাকাটাই স্বাভাবিক। ১৯৩৮ সাল থেকে দীর্ঘ সময় হযরত আজমগীড় (রহঃ) চট্টগ্রাম সফর করেননি। ১৯৫৫ সালে হযরত আজমগড়ী (রহঃ) ভারতের উত্তর প্রদেশে সুদূর আজমগড় থেকে শেষবারের মত সপ্তাহে খানেকের সফরসূচী নিয়ে তশরীফ আনেন। উক্ত সফরকালে প্রখ্যাত জমিদার ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য এয়ার আলী খান সাহেবের বাড়ীতে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) কে লিখিতভাবে খেলাফত দানে ভূষিত করেন।
বিশালত্ব প্রকাশঃ
হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) ১৯৪৬ সাল থেকে হযরত আজমগীড় (রহঃ) হতে খেলাফত লাভ করে গারাংগিয়া মাদরাসার খেদমতের পাশাপাশি তরীক্বতের তবলীগের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ফলে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) ১৯৭৭ সালের ২১ অক্টোবর হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)’র ইন্তেকালের ২/৩ বছর পূর্ব পর্যন্ত নিজেকে তরীক্বত জগৎ থেকে সংকুচিত রেখেছিলেন। কিন্তু হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) তার ইন্তেকালে ২/৩ বছর আগ থেকে তাঁর প্রিয় অনুজ হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) আধ্যাত্মিক জগতের গভীর-বিশালত্ব-বুজুর্গী-কামালিয়ত সর্বমহলে বারে বারে প্রকাশ করে দিতে থাকেন। এতে করে হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) জীবনের শেষ প্রান্ত থেকে তাঁর শরীয়ত ও তরীক্বতের যাবতীয় ফসল হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ)’র প্রতি ঝুঁকে পড়ে। হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) কথার যথার্থতা প্রতিফলিত হতে থাকে। অর্থাৎ হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ)
যে একজন মহান আল্লাহর ওলি এবং বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী তা গারাংগিয়া হামেদিয়া ছিলছিলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম পেরিয়ে দেশে-বিদেশে দ্রুত প্রকাশ পেয়ে যায়।
মানব সেবায় অবদানঃ
হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) মানব কল্যাণের পাশাপাশি শরীয়ত ও তরীক্বতের বিশাল খেদমতে রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেকে মশগুল রাখতে বাধ্য হন। তিনি মানব সেবায় অনন্য নজির স্থাপন করেছে। রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা, দুঃস্থ এবং অভাবীদের সাহায্য, গরীব মেয়েদের বিয়েতে অকাতরে দান, ঈদ-কোরবানীতে গরীবদেরকে বিশেষভাবে দাওয়াত তত্ত্বাবধান, অসংখ্য এতিমের খোরপোষের খবর নেয়া এবং তাদেরকে উপযুক্ত সাহায্য-সহযোগিতা তাঁর নিত্য সময়ের কর্র্র্মসূচী ছিল।
উন্নয়নে অবদানঃ
তাঁর বিশাল ব্যস্ততার ভিতর ও গারাংগিয়া মাদরাসার উন্নয়নে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) সচেষ্ট হন। ১৯৫২ সালের বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর স্বপ্নকে তিনি বাস্তবে রূপদান করেন। অর্থাৎ ১৯৮১ সালে গারাংগিয়া মাদরাসাকে ফাজিল স্তর থেকে কামিল স্তরে উন্নীত করেন। তিনি জীবনের শুরু থেকে ইন্তেকাল অবধি শরীয়ত, তরীক্বত ও মানবীয় যাবতীয় খেদমতের পাশাপাশি গারাংগিয়া মাদরাসার জন্য খেদমত করে গেছেন। এমনকি পূর্বকার আমলে গারাংগিয়াস্থ কেন্দ্রীয় খানকার বার্ষিক মাহফিল প্রথা বন্ধ করে দেন গারাংগিয়া মাদরাসার বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে। তিনি গারাংগিয়া মাদরাসার দালানাদি সম্প্রসারণ ও চার তলা বিশিষ্ট হোস্টেল ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। তিনি গারাংগিয়া মাদরাসার কম্পাউন্ডের জামে মসজিদকে “মসজিদে বায়তুর রহমত” নামকরণ করতঃ বৃহাদাকারের দালানে রূপান্তরিত করেন। গারাংগিয়া মাদরাসার অভ্যন্তর থেকে পৃথক করে শাহ্ মজিদিয়া রশিদিয়া এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তেমনি ভাবে গারাংগিয়া মাদরাসার দালানের ভিতর পৃথক সময়ে ছাত্রীদের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করেন তথা মহিলা মাদরাসা সূচনা করেন। পরবর্তীতে পৃথকভাবে “গারাংগিয়া ইসলামিয়া রব্বানী মহিলা মাদরাসা” নামকরণে পূর্ণাঙ্গ মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। গারাংগিয়া মাদরাসার সংলগ্ন বৃহৎ আকারের পুকুরটির সংস্কার ও বিশাল পাকা ঘাট নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সাতকানিয়া উপজেলা সদর থেকে এলাকাবাসী সহ গারাংগিয়া হামেদিয়া ছিলছিলার সবাইকে প্রতিকুল যোগাযোগ ব্যবস্থা মাথা পেতে নিয়ে যাতায়ত করতে হতো। তিনি আরাকান মহাসড়কের তেওয়ারী হাট থেকে গারাংগিয়া মাদরাসা পর্যন্ত নতুন সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং ডলু খালে (নদী) ব্রীজ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। পরবর্তীতে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারী তহবিলে এ সড়ক ও সেতুর পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) নিজের নাম উপেক্ষা করে তার পিতৃতুল্য বড় ভাই ও অভিভাবক হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)’র নামে এ সড়ক ও সেতুর নাম করণ করেন “শাহ্ মজিদিয়া রোড” ও শাহ্ মজিদিয়া ডলু ব্রীজ”
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করার অবদানঃ
১৯৭৭ সালে হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর ইন্তেকাল থেকে হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ)শরীয়ত ও তরীক্বতের খেদমতের উদ্দেশ্যে গারাংগিয়া বসে যেমন ব্যস্ত সময় কাটাতেন তেমনি দেশের বৃহত্তর পরিসরে সফর ও করতেন। ফলশ্রুতিতে তাঁরই পৃষ্টপোষকতায় দেশে অনেক ধর্মীয় ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সফর করে সেখানে তরীক্বতের খানেকাহ, এতিমখানা, মসজিদ এবং মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।
তরীক্বতের যোগ্য লোক গঠনে অবদানঃ
তিনি হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)’র খলিফাগণের মধ্যে যারা জীবিত ছিলেন তাদেরকে পৃথকভাবে খেলাফত দানে ভূষিত করেন এবং পরবর্তীতে হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)’র মুরীদগণ থেকে যোগ্য বিবেচনা করে বেশ কয়েকজনকে খেলাফত দান করেন। তাঁর হাতে বায়আত হয়ে হাজার হাজার মুসলমান নর-নারী শরীয়ত ও তরীক্বতের আলোতে আলোকিত হন।
চিকিৎসা সেবায় অবদানঃ
হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) ইসলাম ধর্মের চিকিৎসা শাস্ত্র ইউনানী তথা হেকমী চিকিৎসায় যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন, ফলশ্রুতিতে মানব কল্যাণে এ বিষয়ের উপযুক্ত ও ফলপ্রসু দিকনির্দেশনা দিতেন। তিনি তাঁর সাথে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের দৈনিক অধিকহারে পানি পান করতে উপদেশ দিতেন।
প্রকাশনায় অবদানঃ
তিনি একাধিক ধর্মীয় গ্রন্থ রচনা করে গেছেন এবং মাসিক ধর্মীয় ম্যাগাজিন হিসেবে “আল ইসলাম” প্রকাশ করে দীর্ঘদিন দ্বীনের খেদমত করেছিলেন। তিনি তাঁর দাদা মুরশীদ হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী শাহ্ (রহঃ) এর জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন। তথায় তিনি একটি অতি উচু মাপের আরবী ক্বসিদা তথা কাব্যমালা রচনা করেন, যা আরবী সাহিত্য অতি উচু স্থান দখল করে আছে।
হজ্বব্রত পালনঃ
হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) জীবনে তিনবার পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছিলেন। প্রথমবার ১৯৫৬/৫৭ সালে চট্টগ্রাম সামুদ্্িরক বন্দর থেকে সাগরপথে হজ্ব গমন করেছিলেন। ২য় বার ১৯৭৮ সালে এবং ৩য় বার ১৯৭৮ সালে ঢাকা থেকে হজ্বে গমন করেছিলেন।
সুন্নতের অনুসরণঃ
হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) তরীক্বতের পাশাপাশি শরীয়তের উপর কঠোর ছিলেন তেমনি পরিপূর্ণ সুন্নতের পাবন্দ ছিলেন। কখনো সুন্নতের খেলাপ একটি কাজও তাঁর জীবনে দেখা যায়নি। স্বীয় হুজরাখানার সামনে একটি বড় পিড়িতে বসে অজু করতেন, কিন্ত কেবলা মুখী হয়েই অজু করতেন। মাঝে-মধ্যে টুথপেষ্ট ব্যবহার করলেও তা মোটা মিসওয়াক দিয়ে করতেন, যাতে সুন্নতের খেলাপ না হয়। গোসল করার সময় তাঁর শরীর মোবারক কেউ দেখেনি। তিনি হাম্মামখানায় কাউকে ঢুকতে দিতেন না। একটি সুন্নত পরিহার না হওয়াই তার সবচেয়ে বড় কারামত। তেমনিভাবে তাঁর হালাল-হারাম ফরখ ও তাকওয়া-পরহেজগারীর প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি উল্লেখযোগ্য। তাঁর কারামতের দিকে দৃষ্টি দিলে এত বেশি কারামত রয়েছে যে তাঁর জীবনী গ্রন্থ ছাড়া এ সংক্ষিপ্ত ২/৪ টি উল্লেখ করা সমুচিত মনে করিনি।
সময়ের সদ্ব্যবহারঃ
তিনি ধারণাতীত ব্যস্ততার মধ্যেও সমেয়র অত্যাধিক গুরুত্ব দিতেন। মানব কল্যাণে হাজত নিয়ে আগতদের ধারণাতীত সমাগমকে ন্যূনতম বিরক্তি প্রকাশ করতেন না । তিনি শরীয়ত-তরীক্বত, সাংসারিক-শারীরিক নানাবিধ দুর্দশাগ্রস্তদের যথাযথ উপদেশ, পরামশ ও উপযুক্ত ব্যবস্থা দানে সন্তষ্টচিত্বে তথা আত্মতুষ্টি করে বিদায় করতেন। এসব ব্যবস্থার মধ্যে তিনি সময় ও নিয়মানুবর্তিতা ঠিক রাখতেন এবং সফরের সূচির গুরুত্ব ও সময় ঠিক রাখতে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি দিন রাত ২৪ ঘন্টা প্রতি মুহুর্তকে মূল্য দিতেন। রাত ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তেন। যথা নিয়মে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়ে পড়তেন। ফজরের নামাজ পড়ে এশার ওয়াকত পর্র্যন্ত মোরাকাবায় থাকতেন। বাদে মাগরিব সালাতুল আওয়াবীন পড়ে জরুরী প্রোগ্রাম না থাকলে আধ ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা মোরাকাবা করতেন। অতঃপর উপস্থিত সাক্ষাত প্রার্থীদের প্রয়োজন মতে বায়আত, ছবক ও তোয়াজ্জু দিতেন। সকাল থেকে মাগরিব পর্যন্ত গারাংগিয়া মাদরাসার খেদমত, সফর, মানবকল্যাণে সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।
মেহমানদারীঃ
মেহমানদারীতে তাঁর তীক্ষè দৃষ্টি ছিল। কোন মেহমান, সে সাধারণ একজন ছাত্র হলেও তাঁর হুজরা শরীফে প্রবেশ করলে মেহমানদারী গ্রহণ ছাড়া আসতে পারতো না। ইন্তেকালের পূর্ব মুহুর্তেও মেহমানদারীর প্রতি তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল। চোখ খুললেই যদি মেহমান দেখতেন হাতের ইশারায় মেহমানদারীর ব্যবস্থা করতেন। তিনি গারাংগিয়া মাদরাসা দালানে তাঁর হুজরা কক্ষে বিভিন্ন শুকনা নাস্তা রাখতেন, যাতে করে তৎক্ষণাৎ মেহমানদারী করা যায়।
মুসলিম উম্মাহার ঐক্যঃ
হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) গারাংগিয়া মাদরাসা কমপ্লেক্স সহ শরীয়ত ও তরীক্বতের বিশাল খেদমতের পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রচেষ্ঠা চালিয়ে গিয়েছেন। আজমগড়ী ছিলছিলা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত ও সুন্নী আক্বিদা পোষণ করে থাকে। কিন্ত হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ) নিজ আক্বিদার উপর দৃঢ় থেকে অন্যান্য আক্বিদার ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণের সাথে যোগাযোগ ও সু-সম্পর্ক রক্ষা করতে এবং ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে একই প্লাটফর্মে সমবেত করে ধর্মীয় সুশীলতল ভ্রাতৃত্ব আবদ্ধ করার জন্য বারে বারে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এ জন্য তিনি “ ইত্তেহাদুল উলামাহ ওয়াল মুসরলেমীন” নামে একটি সংগঠন ও গড়েছিলেন।
ইন্তেকালঃ
মোজাদ্দেদে জমান অলিয়ে কামেল হযরত আলহাজ্ব শাহ্ আবদুর রশীদ ছিদ্দীক হামেদী (রহঃ) তথা এ মহান আল্লাহর ওলি পরিণত বয়সে ১৯৯৪ সালের ৪ নভেম্বর, ১৪১৫ হিজরী ২৯ জমাদিউল আউয়াল, ১৪০৩ বাংলা ২০ কার্তিক জুমাবার সকাল ৭ ঘটিকার সময় গারাংগিয়াস্থ নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্ব মুহুর্তে তিনি শয়ন অবস্থা থেকে বসে গিয়ে আল্লাহর সর্বোচ্চ মর্যাদা ঘোষণা দিয়ে বললেন, “আল্লাহু আকবর”। অতঃপর তাঁর মহান রবের সান্নিধ্যে জান্নাতি মেহমান হিসেবে হাজিরা দিলেন। লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগমে ঐ দিন বাদে আছর নামাজে জানাজা শেষে গারাংগিয়া মাদরাসা মসজিদ সংলগ্ন হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ) এর কবর শরীফের পূর্ব পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। হযরত বড় হুজুর কেবলা (রহঃ)ও হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ)’র পাশাপাশি কবর শরীফদ্বয়ে নিয়মিত জেয়ারত জারী রয়েছে এবং সাথে সাথে ধর্মপরায়ণ ও ত্বরিক্বতের গভীরে বিরাজমান জেয়ারতের সাথে সাথে ফুয়ূজাত লাভে ধন্য হচ্ছেন। মহান আল্লাহ পাক যেন হযরত ছোট হুজুর কেবলা (রহঃ)’র রুহানী ফুয়ূজাত দ্বারা আমি অধমকে সিক্ত রাখেন। আমিন।